শ্রদ্ধেয় সৌমিত্র বাবু,
আমার প্রণাম নেবেন। আপনাকে ভালোবেসেই প্রথম বাংলা সিনেমার সামনে বসা। “অপুর সংসার” দেখতে বসে দুঃখ যে পাইনি তা নয়। দেখেছিলাম, অন্যরকমের একটা সিনেমা। যেখানে রোমান্স আছে, তবে সেটা ভীষণই সূক্ষ্য। একশো সতেরো মিনিটের একটা ছবি, আই.এ পাশ করে অপু ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে ওখানে, তার একটা চাকরি চাই। শেষ দৃশ্যটা আজও মনে পরে, অপুর কাঁধে চেপে কাজল চলেছে কলকাতায়। বার বার দেখেছি। এর পরের ছবি, দেবী। সেটাও দেখেছি। মুগ্ধ হয়ে দেখেছি উমাপ্রসাদ কে। এরপর তিনকন্যা, ঝিন্দের বন্দী; সব গুলোই দেখেছি। ষাটের দশকের শুরুতে অজয় কর তৈরী করেছিলেন অতল জলের আহ্বান। খুব ভালো লেগেছিলো সিনেমাটা। জয়ন্তর চরিত্রে সৌমিত্র বাবু। এরপর সাত পাঁকে বাঁধা, বর্ণালী কিংবা চারুলতা। আপনার প্রত্যেকটা সিনেমা বেশ অন্যরকম। চরিত্র গুলোর মধ্যে একটা মেরুদন্ড আছে। এই যেমন সাত পাকে বাঁধা-র সুখেন্দু চরিত্র টা। নায়ক, কিন্তু চোখে কাজল পরা নায়ক নয়। চরিত্র টার মধ্যে প্রতিবাদ আছে। এই সময়কার দুটো সিনেমা অসাধারণ লেগেছিলো আমার। কিনু গোয়ালার গলি আর কাঁচ কাটা হিরে। বাংলা সিনেমা তখন তপন সিংহ, অজয় কর, অসিত সেন কিংবা তরুণ মজুমদারদের হাত ধরে নতুন কিছু বলছে।
ছক ভাঙা গল্প, চরিত্র গুলো যেন বাঁচার গল্প বলছে। আকাশ কুসুম, মনিহার থেকে তিন ভুবনের পারে। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলবো। উত্তমকুমার তখন দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন। তার পাশেও আপনি দাঁড়িয়ে আছেন মাথা উঁচু করে। নব্বই দশকে যখন আমরা কৈশোর থেকে যৌবনে ঢুকছি আপনি তখন আমাদের আদর্শ। আপনি মানে কবিতা লেখা, আপনি মানে আবৃত্তি, আপনি মানেই লিটল ম্যাগাজিন, আপনি কখনো অন্য নায়ক দের মতো নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয়, মানুষের মধ্যে স্বচ্ছন্দ। গল্ফ গ্রীনে আপনাকে দেখেছি মর্নিং ওয়াক করতে। আশপাশের মানুষরা কথা বললেই সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতেন আপনি, ভিড়ের মধ্যে একদম আলাদা। তখন আমাদের রাজনৈতিক মন। এই সিস্টেম বদলানোর স্বপ্ন চোখে মুখে। দেয়াল লেখা থেকে পোষ্টার তৈরী, ব্যস্ত সময়েও আপনার অভিনীত সিনেমা খুঁজে দেখা। ওই যে আপনার অভিনীত চরিত্র মানেই একটা আলোর খোঁজ যেন। দীনেন গুপ্ত-র বসন্ত বিলাপ আজও কোথাও দেখলে বসে পরি। উদয়ন পন্ডিত, আপনি ছাড়া কে হবে বলুন তো? আপনার অভিনীত ফেলুদা সময় কে পেরিয়ে গেছে অনেক দিন। ঘরে বাইরের সন্দীপ, সে ও তো প্রথা ভাঙা চরিত্র। আসলে এই ব্যবস্থায় প্রশান্ত আছে। আছে কোনির ক্ষিদ্দা। অশোক গুপ্ত রাও আছে। সেই কবে হুইল চেয়ার এ বসে যে ডাক্তার স্বপ্ন দেখিয়েছিলো আমাদের, সেই হয়তো লড়াকু মানুষদের বলেছিলো ফাইট, ফাইট। আপনার সাথে দেখা করতে খুব ইচ্ছা করতো। হলোনা। সব কিছু একটা জীবনে হয়না যে। একটা জীবনে "ফেরা" ও হয়না। তবু নাম জীবন থেকে রাজকুমাররা মনে থেকে যায়।
অনেক শ্রদ্ধা। যেখানেই থাকুন, খুব ভালো থাকুন আপনি।
ইতি বিনীত,শঙ্খ দত্ত।
0 Comments