এক ঝলকে

10/recent/ticker-posts

Advertisement

8844

মানবপ্রেমিক এস. ওয়াজেদ আলীর প্রাসঙ্গিকতাঃ আব্দুল হাকিম

 আব্দুল হাকিমঃ এস.ওয়াজেদ আলী মুসলিম মৌলবাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষনা করেছিলেন। তাই “মহাম্মদী” পত্রিকার বিচারে সেরা মুসলিম সাহিত্যিকদের পংক্তিতে তার জায়গা হয়নি। অথচ তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান আস্তিক। তিনি নিজেই বলেছেন, “ধৰ্ম্মে আমি একান্ত ভাবে আস্থা রাখি, আর ধর্মকে আমি জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ বলেই মনে করি ”। (রাষ্ট্রের রূপ / ভবিষ্যের বাঙালী)। ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিদিন ভোরে উঠে তিনি কোরান পাঠ করতেন বলে শোনা  গেছে। সামাজিক জীবনে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানকেও বর্জন করেন নি। কিন্তু তা বলে ধর্মে অন্ধত্ব ও গোঁড়ামীর কাছে কখনো আত্মসমর্পন করেন নি। ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও গোঁড়মীর ঔরসে জায়মান  ধর্মীয় মৌলবাদকে আশ্রয় করেই প্রসারিত হয় সাম্প্রদায়িক হিংস্রতা।  ধ্বংস-মৃত্যু-বিভেদ-বিনাশ-আতঙ্ক-ঘৃণাসংশয়ের সৃষ্টি এই সংকীর্ণ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার গর্ভে! এ তার উপলব্ধির মধ্যে ছিল। তাই তিনি মনে করতেন - গোঁড়া ধার্মিক কখনো প্রকৃত ধার্মিক হতে পারে না। তার মতে, “যারা প্রকৃত ধার্মিক, তারা ধর্মের শাশ্বত অংশের উপরেই ধর্ম সাধন ভিত্তি স্থাপন করেন; ..... পক্ষান্তরে, যারা ধর্মের প্রকৃত আদর্শের সঙ্গে সংস্রব রাখেন না, অথচ ধৰ্ম্মকে উপলক্ষ্য করে ধৰ্ম্মের আদর্শের অনুসরণ করতে চান, তারা ধর্মের শাশ্বত এবং চিরন্তন আদর্শগুলিকে বর্জন করেন এবং তার আপেক্ষিক অংশগুলিকে অবলম্বন করে প্রকৃত ধার্মিক এবং সত্যসাধকদের বিরুদ্ধে তুমুল সংগ্রাম উপস্থিত করেন।” ” (রাষ্ট্রের রূপ | ভবিষ্যতের বাঙালী)। এই “ধৰ্ম্মের ধুরন্ধর” স্বার্থবাজরাই প্রকৃত ধর্মীয় আদর্শের প্রবক্তা যীশুকে ‘ক্রশ কাষ্ঠে’ ঝোলায়, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে প্রকৃত মানবতার রক্তক্ষরণ ঘটায়, আত্মসংযমের ‘জেহাদ’কে মানুষ মারার ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার করে তোলে। শান্তির ধর্মের অভিঘাতে মানুষ রক্তাক্ত হয়, পথ পিচ্ছিল হয়, মমতাময় হৃদয় ঝঁঝরা হয় বুলেটে, স্নেহের সম্পর্কভেঙে টুকরো হয়, মানবিক মূল্যবোধ ধূলোয় লুটোয়। আমরা শুধুমাত্র ‘জীব’ হয়ে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা করে যাই,আমাদের মনুষ্যত্ববোধ হারিয়ে যেতে থাকে সংকীর্ণ প্রতিক্রিয়ার গভীরে। মেকী মৌলবাদের জেহাদী চক্রান্তের  বিরুদ্ধে তাই প্রকৃত জেহাদ করে যেতে হয় আজীবন মানবতাবাদী ওয়াজেদ আলীকে।

 


        মৌলবাদের এই মেকী জেহাদের চিত্রটা পাল্টায় নি। সাম্প্রদায়িকতার হিংস্র আগুনে গুজরাটের কালো রাজপথ লাল হয়ে ওঠে। বেস্ট বেকারীর আগুনে রুটির বদলে ঝলসে কাঠ কয়লা হয় এক বিশেষ সম্প্রদায়ের দেহ। গর্ভবতী মায়ের গর্ভপাত ঘটে নরঘাতক মনুষ্য চামড়ার পশুদের ধারালো তরবারির আঘাতে। বল্লমের ফলায় গাঁথা ছোট্ট শিশুর দেহ তাল গোল পাকিয়ে পৈশাচিক উল্লাসের কারণ হয়ে ওঠে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বদান্যতায় ইরাকে লাশের পাহাড় গড়ে ওঠে। আফগানিস্তানে জেহাদি শক্তির ধ্বংসের নামে বলি হয় অসংখ্য সাধারণ মানুষ। মৌলবাদী সন্ত্রাসবাদের উত্তপ্ত বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যায় গোটা দুনিয়ার হৃদয়। জম্মু-কাশ্মীর, আসাম, বিহার, ওড়িষ্যায় দূর্বল শ্রেণীর লাঞ্ছনা- প্রাণহানি ঘটে যায় আর এক মৌলবাদী শক্তির উদগ্র কামনায়। এমনি অসংখ্য ঘটনার ভিড় তৈরী হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

        প্রায় সাতদশক আগে এস.ওয়াজেদ আলী চেয়েছিলেন মৌলবাদী সাম্প্রদায়িকতার বিনাশ। এখন পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ কি তা চাইছেন না?  যুদ্ধ বন্ধ হোক সন্ত্রাসবাদ-মৌলবাদ ধ্বংস হোক –এ দাবিতো শান্তি প্রিয় মানুষ মাত্রেরই। তাই এস.ওয়াজেদ আলীর সাহিত্য কেবল অতীত স্মৃতির রোমান্থন নয়, শুধু ফিরে দেখা সুখ-বিলাস নয়  কেবলমাত্র ভারতীয় ঐতিহ্যের চিরন্তনতার শ্লাঘা অনুভব নয় - প্রাসঙ্গিক খুবই প্রাসঙ্গিক - যা আমাদের মধ্যেকার বিভেদের প্রাচীর ভেঙ্গে মানবত্ববোধে আমাদের সিক্ত করে। সত্য হয়ে ওঠে এক অনাস্বাদিত উপলব্ধি। তার কথাতেই আমাদের বলতে ইচ্ছা যায়- “আমি মুসলমান সমাজের বটে, কিন্তু তারও উপর আমি মানুষ, আমি ভারতবাসী বটে, কিন্তু তারও উপর আমি মানুষ, আমি বাঙালী সমাজের বটে,কিন্তু তারও উপর আমি মানুষ”।(সাহিত্য ও জীবনের শিল্প)। মুসলমানত্ব নয়, বাঙালীয়ানা নয়, ভারতীয়তাও নয়—বিশ্ব মানবত্ববাদের অঙ্গীকার নিয়েই তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। এখানেই এস.ওয়াজেদ আলী বিশ্বজনীন মানবতার এক উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন ।

         বাংলা ও বাঙালীর মঙ্গল নিয়ে তার নানা ভাবনার কথা তার সাহিত্যের একটা অংশ জুড়ে আছে। বাংলার মঙ্গল কখনো হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার মাটির ওপর গড়ে উঠতে পারে না। বাংলার উন্নয়ন ঘটাতে হলে সর্বাগ্রে এই দুই সম্প্রদায়ের ঐক্যকে নিশ্চিত করা দরকার। এ জন্য মুসলমান সম্প্রদায়ের উৎস-অতীত নিয়ে বিচলিত হবার কি কোন যুক্তি আছে? অতীত গৌরবের চর্বিতচর্বন করে নিজেদের  বিচ্ছিন্ন করে রাখার পিছনে যৌক্তিকতাই বা কতটুকু? বাঙালী মুসলমানের দেহে হিন্দুর  রক্ত প্রবহমান, না বিদেশীর রক্ত, আর্যের রক্ত, না অনার্যের এ নিয়ে বিতর্ক-বিবাদের ডামাডোলে আসল সত্যটাই হারিয়ে যায় অনায়াসে। সুক্ষ্ম তত্ত্বকথার ভিড়ে আমাদের প্রকৃত উপলব্ধিটাই উপেক্ষিত থেকে যায়। তাই তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেন –“বাঙালী মুসলমানের ধমনীতে বিদেশীর রক্তও আছে, আর এদেশীয় রক্তও আছে, আর্যের রক্তও আছে, আর অনার্যের রক্তও আছে, তথাকথিত উচ্চজাতীয় হিন্দুর রক্তও আছে, তথাকথিত নীচ জাতীয় হিন্দুর রক্তও আছে। এসবকে নিয়ে আমাদের গৌরব করতে হবে, আর মনে রাখতে হবে,“এখন আমরা হচ্চি বাঙালী”। বাঙ্গালার মঙ্গল হচ্ছে আমাদের আদর্শ। বাংলার গৌরব, বাংলার স্বাতন্ত্র, বাঙ্গালার বিশেষত্ব হচ্ছে আমাদের সাধনার বিষয়। এ আদর্শ যেদিন প্রকৃতই আমার অন্তর অধিকার করবে, সেদিন হিন্দু মুসলমানের বিরোধেরও শেষ হবে। কেননা, হিন্দু-মুসলমান, উভয়ের মঙ্গল ছাড়া বাঙ্গালার মঙ্গল হতে পারে না, আর হিন্দু ও মুসলমানের সম্প্রীতি ছাড়া বাংলার গৌরব মাথা তুলতে পারে না।” (বাঙ্গালী মুসলমানঃ জীবনের শিল্প)।

        বাংলার গৌরবকে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে, জগতসভায় ভারতের আসনকে পাকা করতে হলে আমাদের যা সর্বাগ্রে প্রয়োজন, তা হল ঐক্যবোধ।এ উপলব্ধি এস.ওয়াজেদ আলীর ছিল, এখন আমরাও তা  মনে মর্মে উপলব্ধি করি। বিষয়ের সাযুজ্যের সঙ্গে ভাবনার সমান্তরালতা মিলে মিশে এক হয়ে যায় অনেকটাই। স্বদেশের কল্যাণবোধ, সামাজিক সুস্থিতি ও মানব মঙ্গলের বাস্তবতা ঘটাতে বিকল্প কোন পথের সন্ধান কি আছে? সর্ব ধর্মকেন্দ্রিক জাতিসত্তার মিলনে গড়ে ওঠা ঐক্যবদ্ধ শক্তিই তো পারে স্বদেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে— এটাই আমাদের বিশ্বাস। প্রত্যয়ের এই দ্বীপভূমিতেই আমরা খুঁজে পেয়ে যাই মানবপ্রেমিক এস.ওয়াজেদ আলীর প্রাসঙ্গিকতা।

 

 

Post a Comment

0 Comments